ঢাকাThursday , 24 November 2022

সঙ্গীতসাধক বারী সিদ্দিকীর জন্মদিন আজ

Zero News
November 24, 2022 10:46 am
Link Copied!

লোকগান ও আধ্যাত্মিক ধারার গানের জন্য পরিচিত প্রখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী বারী সিদ্দিকী গত শতকের শেষ দিকে সারাদেশের শ্রোতাদের কাছে পৌঁছান কথাসাহিত্যিক ও নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদের হাত ধরে। চলচ্চিত্রের প্লেব্যাকে তার দরদী কণ্ঠের বেশ কিছু আবেগমাখা গান দারুণ জনপ্রিয়।

তার গলার আওয়াজটা একেবারেই আলাদা। বারী সিদ্দিকীর আদলে গান গেয়ে অনেকেই আজ জনপ্রিয়। তার গাওয়া ‘শুয়া চান পাখি, ‘আমার গায়ে যত দুঃখ সয়’, ‘সাড়ে তিন হাত কবর’, ‘তুমি থাকো কারাগারে’, ‘রজনী’ প্রভৃতি গানের জন্য তিনি সঙ্গীতপ্রেমীদের কাছে অত্যাধিক সমাদৃত।

আজ ১৫ নভেম্বর জনপ্রিয় এই সঙ্গীতশিল্পীর জন্মদিন। ১৯৫৪ সালের এই দিনে ভাটি অঞ্চলের জেলা নেত্রকোণায় আবদুল বারী সিদ্দিকীর জন্ম। ২ ভাই এক বোনের মধ্যে বারী সিদ্দিকী ছিলেন সবার ছোট। শৈশবে পরিবারেই তার গান শেখার হাতেখড়ি। কিশোর বয়সে নেত্রকোণার শিল্পী ওস্তাদ গোপাল দত্তের কাছে তালিম নিতে শুরু করেন বারী। পরে ওস্তাদ আমিনুর রহমান, দবির খান, পান্নালাল ঘোষসহ বহু গুণীশিল্পীর সরাসরি সান্নিধ্য পান।

ওস্তাদ আমিনুর রহমান একটি কনসার্টের সময় বারি সিদ্দিকীকে অবলোকন করেন এবং তাকে প্রশিক্ষণের প্রস্তাব দেন। পরবর্তী ছয় বছর ধরে তিনি ওস্তাদ আমিনুর রহমানের অধীনে প্রশিক্ষণ নেন। সত্তরের দশকে জেলা শিল্পকলা একাডেমির সাথে যুক্ত হন। ওস্তাদ গোপাল দত্তের পরামর্শে ক্লাসিক্যাল মিউজিক এরপর পড়াশোনা শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে বাঁশির প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন ও বাঁশির ওপর উচ্চাঙ্গসঙ্গীতে প্রশিক্ষণ নেন। নব্বইয়ের দশকে ভারতের পুনে গিয়ে পণ্ডিত ভিজি কার্নাডের কাছে তালিম নেন। দেশে ফিরে এসে লোকগীতির সাথে ক্লাসিক মিউজিকের সম্মিলনে গান গাওয়া শুরু করেন। সঙ্গীতের এক নিরন্তর সাধক ছিলেন বারী সিদ্দিকী।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রী অর্জনকারী বারী সিদ্দিকীর মেয়ে এ্যালমা সিদ্দিকী বিদেশে পড়াশুনা করেছেন। এ্যালমা সিদ্দিকীও একজন বাউল শিল্পী। বাবার সাথে একাধিকবার একই মঞ্চে একই টিভি শোতে গান করেছেন এ্যালমা।

মূলত, বংশী বাদক বারী সিদ্দিকী কথাসাহিত্যিক ও চিত্রনির্মাতা হুমায়ূন আহমেদের প্রেরণায় নব্বইয়ের দশকে সঙ্গীত জগতে প্রবেশ করেন এবং অল্পদিনেই বিরহ-বিচ্ছেদের মর্মভেদী গনের মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষের হৃদয়ে স্থায়ী আসন করে নেন। জীবদ্দশায় এক সাক্ষাৎকারে সিদ্দিকী বলেছেন, ‘হুমায়ূন আহমেদ আমার গাওয়ার পেছনে যথেষ্ট উৎসাহ দিয়েছিলেন। মূলত তার সাহস নিয়েই সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রয়াস পেয়েছি।’

ঢাকার বিভিন্ন স্টুডিওতে বাঁশি বাজিয়ে বেড়ানোর মধ্যেই ১৯৯৩ সালে হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিনে তার বাসায় এক অনুষ্ঠানে বাঁশি শোনাতে যান বারী সিদ্দিকী। সেই অনুষ্ঠানে বারীর বাঁশির চেয়ে তার কণ্ঠে গাওয়া রশিদ উদ্দিন বাউল আর উকিল মুন্সির গানই বেশি পছন্দ হয় হুমায়ূনের। পরে লেখক হুমায়ূনের আগ্রহেই বারীর কণ্ঠে ‘আমার গায়ে যত দুঃখ সয়,’ ‘পুবালি বাতাসে’ গানগুলো রেকর্ড করা হয়।

১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে বারী সিদ্দিকী প্রখ্যাত সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের ‘রঙের বাড়ই’ নামের একটা ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে জনসমক্ষে প্রথম সঙ্গীত পরিবেশন করেন। বহু বছর ধরে সঙ্গীতের সঙ্গে জড়িত থাকলেও গুণী এই শিল্পী দেশব্যাপী পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা পান ১৯৯৯ সালে।

টেলিভিশনে ‘রঙের বাড়ই’ নামে একটি ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে ‘আমার গায়ে যত দুঃখ সয়’ গানটি প্রচার করা হলে বারী সিদ্দিকী পৌঁছে যান সারা দেশের শ্রোতাদের হৃদয়ে সুরের পাখি। এবছর হুমায়ূন আহমেদের রচনা ও পরিচালনায় শ্রাবণ মেঘের দিন চলচ্চিত্রে সাতটি গানে কণ্ঠ দেন বারী সিদ্দিকী। ‘শুয়া চান পাখি’ গানটি সে সময় তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। ওই বছরই জেনেভায় বিশ্ব বাঁশি সম্মেলনে যোগ দেন বারী সিদ্দিকী।

বারী সিদ্দিকী বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রের গানে কণ্ঠ দিয়েছেন ও গানের কথা লিখেছেন। ২০১৩ খ্রিস্টাব্দে সিদ্দিকী ফেরারী অমিতের রচনা ও পরিচালনায় পাগলা ঘোড়া নাটকে প্রথমবারের মত অভিনয় করেন জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী ও নন্দিত এই বংশীবাদক। পরে রূপকথার গল্প, নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ, ও আমার দেশের মাটিসহ আরও কয়েকটি চলচ্চিত্রে প্লেব্যাকে গেয়েছেন এই শিল্পী। তার কণ্ঠের গান নিয়ে ডজনখানেক অ্যালবামও প্রকাশিত হয়েছে।

তার একক অ্যালবামগুলো হচ্ছে-‘দুঃখ রইলো মনে’, ‘সরলা’, ‘ভাবের দেশে চলো’, ‘সাদা রুমাল’, ‘মাটির মালিকানা’, ‘মাটির দেহ’, ‘মনে বড় জ্বালা’, ‘প্রেমের উৎসব’, ‘ভালোবাসার বসত বাড়ি’, ‘নিলুয়া বাতাস’, ‘অপরাধী হইলেও আমি তোর’ এবং ‘দুঃখ দিলে দুঃখ পাবি’।

২০১৭ সালের ২৪ নভেম্বর দিনগত রাত সোয়া দুটার পর রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে ৬৩ বছর বয়সে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এর আগে কয়েকদিন রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয় বারী সিদ্দিকীকে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কণ্ঠশিল্পী, গীতিকার, বাঁশিবাদক বারী সিদ্দিকী হৃদরোগ ছাড়াও কিডনি জটিলতায় ভুগছিলেন। তাকে জেলা সদরের চল্লিশা বাজারের কার্লি গ্রামে নিজ বাড়িতে দাফন করা হয়।